মানবিক পেশায় বীরমুক্তিযুদ্ধা মুর্শিদ আলী

মানবিক পেশায় বীরমুক্তিযুদ্ধা মুর্শিদ আলী
মাহফুজ রাজা,  কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ;
পাত্র-পাত্রী যেমনটি চান, ভাবনা কিছুই নাই, জুটিয়ে দেবেন আনন্দরাম, যেমনটি ঠিক চাই। আনন্দরাম ভালই জানেন আপন কর্মধারা, খুঁতের সাথে খুঁত মিলিয়ে দুইটি হৃদয় জোড়া। এই ভাবেতে শতশত বিয়ে দিয়েছেন তিনি, ঘটক কুলে পরিচিত ঘটক চূড়ামণি।’-‘ছড়ার নায়ক ঘটক আনন্দরাম, ঘটকালি ও বিয়ে নিয়ে ঘটকালির  প্রচলন আদি যুগ থেকেই  ছিল।
একজন সাদা মনের মানুষ বীরমুক্তিযোদ্ধা মুর্শিদ আলী। যিনি সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য মানবসেবায় ব্রত হয়ে ঘটকালি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের গড়মাছুয়া গ্রামে। বয়স ৮০।
জানা যায়, তখন ১৯৭১সাল। দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ। ৬ মাস হল বিয়ে করেছেন। শরীরের তারুণ্যের টগবগে রক্ত উদ্বেলিত হচ্ছে। কানে বেজে উঠল স্বাধীনতার ডাক। দেশ রক্ষার্থে স্বাধীনতাকামী সেই যুবক ছুটে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। কমান্ডার মাজহার আলীর নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। উপার্জনের কোনো রাস্তা নেই। নানান পেশায় জড়িত হয়েও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। ইতোমধ্যে সংসারে নতুন অতিথি দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সাদাসিধে পোশাকে চলাচল তার। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মনে জাগে মানব সেবাব্রত। সেবাই ধর্ম, সেবায় কর্ম। ফলে অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের বন্ধনে আবদ্ধ করে পূর্ণের আশায় নেমে যান ঘটকালি পেশায়। ছেলে অথবা মেয়ে পক্ষ বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর উপঢৌকন হিসেবে তাকে যা দেন তা হাসি মুখে নিয়ে নেন। এ নিয়ে  অন্য ঘটকের মতো দরকষাকষি নেই। একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি।
সেই ২০ বছর বয়স থেকেই  শুরু করে ৫২বছর ধরে এ ঘটকালির পেশায় পথ চলা। আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এ পর্যন্ত ৪৫০টি বিয়ে সম্পন্ন করেছেন ঘটক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুর্শিদ আলী। খুবই প্রত্যুষে বাড়ি থেকে বের হয়ে হাতে একটা পাত্র-পাত্রীর বায়োডাটা ব্যাগ নিয়ে পাত্রের বাড়ি থেকে অন্য পাত্রীর বাড়ি কিংবা এক শহর থেকে অন্য শহরে পাত্র-পাত্রীর সন্ধানে ছুটে চলেন। সংসারে তার ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। সংসারের নেই কোনো অভাব অনটন। মাস শেষ হলেই পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। আরাম-আয়েসের জন্য ঘরে ফ্রিজ, কালার টিভিসহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে। তার ডায়রিতে অনেক পাত্র পাত্রীর বায়োডাটা। বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে অভিভাবকরা তার সাথে যোগাযোগ করেন। ফলে ব্যস্ততায় কাটে তার সময়।
এ পেশা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে মুর্শিদ আলী বলেন, মানুষ খুশি তো আল্লাহ খুশি সম্পর্ক গড়ে দেওয়া মানবসেবা। কথাবার্তা চালানোর মধ্যে কোনোটি যখন লেগে যায়, তখন আর আনন্দের সীমা থাকে না। বিয়ে পর্যন্তই কাজ, তা কিন্তু নয়। অনেকে পরেও যোগাযোগ রাখেন।
ঘটকালি পেশা এখন অনেকেই ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আপনি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে এখনো ঘটকালি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন কেন? জবাবে  মুর্শিদ আলী বললেন, বিয়ে হলো পবিত্র বন্ধন। এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছেন, যাঁরা শুধু লেখাপড়াটাই করেছেন, সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পাননি, অনেকে এখনো পরিবারের অমতে বিয়ে করতে চান না। আল্লাহর  সন্তুষ্টির কারণে এই মহৎ কাজের সাথে নিজেকে জড়িত রাখছি।
এত বছর ধরে ঘটকালিতে কীভাবে টিকে আছেন? এমন প্রশ্নে ঘটক মুর্শিদ আলী বললেন, তিনি তিনটি জিনিস মানেন, ১৮ বছরের নিচে বিয়ের সম্বন্ধ করেন না; যে বিয়েতে পাত্রপক্ষ যৌতুক চায়, সে বিয়ে এড়িয়ে যান। আর কখনো কেউ মিথ্যা বললে সম্পর্ক নিয়ে এগোন না। মিথ্যার ওপর সম্পর্ক টেকে না—এই তার বিশ্বাস।

আপনি আরও পড়তে পারেন